Ad Code

“Politics is the art of looking for trouble, finding it whether it exists or not, diagnosing it incorrectly, and applying the wrong remedy.”

একজন জহির রায়হান এবং তাঁর অন্তর্ধান কথকতা

জহির রায়হান প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার।


জহির রায়হান
জন্ম
আগস্ট ১৯, ১৯৩৫ (বয়স ৭৬)
ফেনী, বাংলাদেশ
মৃত্যু ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২। মীরপুরে তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ খুঁজতে গিয়ে নিঁখোজ হন, এবং আর ফিরে আসেননি।
পেশা চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক
জহির রায়হান (আগস্ট ১৯, ১৯৩৫ – জানুয়ারি ৩০, ১৯৭২) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার।
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকেবিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
কর্মজীবন
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবেপ্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরাছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকএহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়াতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
অন্তর্ধান ও মৃত্যু
জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। মীরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা এবং এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।
পরিবারের উল্লেখযোগ্য সদস্য
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের দুই স্ত্রী’র একজন সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আরেক স্ত্রী সুচন্দা’র ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি ‘সবুজ কোট কাল চশমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। জাহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার।
জীবনপঞ্জি
■১৯৩৫: জন্ম ১৯ আগস্ট, মজুপুর গ্রাম, ফেনী।
প্রাথমিক লেখাপড়াঃ মিত্র ইন্সটিটিউট, কলকাতা।
আলিয়া মাদ্রাসা, কলকাতা।
■১৯৪৯: নতুন সাহিত্য পত্রিকা (কলকাতা)-য় ওদের জানিয়ে দাও শীর্ষক কবিতা প্রকাশিত।
■১৯৫০: আমিরাবাদ হাইস্কুল (ফেনী) থেকে মেট্রিক পরীক্ষা।
■১৯৫১-১৯৫৭: কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সরাসরি জড়িত।
■১৯৫২: : ছাত্র অবস্থাতেই মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহন।
মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ থেকে জহির রায়হানে পরিণত।
প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফি স্কুল (কলকাতা)-য় ভর্তি।
■১৯৫৩: জগন্নাথ কলেজ (ঢাকা) থেকে আই.এস.সি পরীক্ষা।
■১৯৫৬-১৯৫৮: কোর্স শেষ না করেই চিকিৎসাশাস্ত্র (মেডিক্যাল কলেজ) ত্যাগ।
■১৯৫৬: পাকিস্তানের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক জারদরি-এর সহকারী মনোনীত হয়ে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ।
■১৯৫৮: : বি.এ.অনার্স (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পঞ্চাশের দশকে ছাত্র অবস্থায় প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্য গ্রহণ প্রকাশিত।
■১৯৬১: : প্রথম চলচ্চিত্র কখনো আসেনির মুক্তি লাভ।
চিত্রনায়িকা হেনা লাহিড়ী সুমিতা দেবীর সাথে পরিণয়।
পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন ছবি সঙ্গম (উর্দু ভাষায়) তৈরি।
■১৯৬৪: হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য আদমজী পুরস্কার লাভ।
■১৯৬৮: চিত্রনায়িকা কোহিনূর আকতার সুচন্দার সাথে পরিণয়।
■১৯৭০: পাকিস্তানের প্রথম রাজনৈতিক-চেতনামন্ডিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তিলাভ।
■১৯৭১: : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ।
মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রথম চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইড নির্মাণ।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র এ স্টেট ইজ বর্ন নির্মাণ।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র ইনোসেন্ট মিলিয়ন (পরিচালকঃ বাবুল চৌধুরী) এবং লিবারেশন ফাইটার্স (পরিচালকঃ আলমগীর কবীর)-এর তত্ত্বাবধান।
বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশ মুক্তি পরিষদ (Bangladesh Liberation council of Intelligentsia)-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত।
■১৯৭১: সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ (১৯৭২ সালে ঘোষিত)
■১৯৭২: বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠন।
■১৯৭২: নিখোঁজ (৩০ জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত)।
■১৯৭৭: চলচ্চিত্র শিল্পে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ।
■১৯৯২: সাহিত্যে কৃতিত্বের জন্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ।
পুরস্কার
■আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ১৯৬৪। (হাজার বছর ধরে)
■নিগার পুরস্কার (‘কাঁচের দেয়াল’) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে।
■বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৭১। (উপন্যাসঃ মরণোত্তর)
■একুশে পদক ১৯৭৭। (চলচ্চিত্রঃ মরণোত্তর)
■স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৯২। (সাহিত্যঃ মরণোত্তর)
উল্লেখযোগ্য কাজ
উপন্যাস
■শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০)। প্রথম উপন্যাস। প্রকাশকঃ সন্ধানী প্রকাশনী। রোমান্টিক প্রেমের উপাখ্যান।
■হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত আখ্যান। (চলচ্চিত্ররূপ, ২০০৫)
■আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)। বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কথামালা।
■বরফ গলা নদী (১৯৬৯)। প্রথম প্রকাশঃ ‘উত্তরণ’ সাময়িকী। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাঁথা।
■আর কত দিন (১৯৭০)। অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্নকথা।
অন্যান্য রচনা
■সূর্যগ্রহণ। প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১৩৬২ বাংলা।
■তৃষ্ণা (১৯৬২)।
■একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০)।
■কয়েকটি মৃত্য।
চলচ্চিত্র
জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ হচ্ছেঃ
■কখনো আসেনি (১৯৬১)।
■সোনার কাজল (১৯৬২)। (কলিম শরাফীর সঙ্গে যৌথভাবে)
■কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩)।
■সঙ্গম (১৯৬৪)।
■বাহানা (১৯৬৫)।
■আনোয়ারা (১৯৬৭)।
■বেহুলা (১৯৬৬)।
■জ্বলতে সূরযকে নীচে।
■জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)।
■স্টপ জেনোসাইড (চলচ্চিত্র) (১৯৭১)।
■এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১)।
■লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত) (১৯৭০)।
পত্রিকা সম্পাদনা
■এক্সপ্রেস (ইংরেজি সাপ্তাহিক)।
■প্রবাহ (বাংলা মাসিক)।

একজন জহির রায়হান এবং তাঁর অন্তর্ধান কথকতা

মনসুরুল হক খান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর যেসব শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী শরণার্থী হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন জহির রায়হান তাদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দুটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানেও তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছিলেন। কলকাতায় তাকে বেশ দুঃসহ জীবনযাপন করতে হয়েছিল। স্বীয় অর্থকষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটির ভারতে প্রদর্শনীর বিনিময়ে বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে দান করেছিলেন। কলকাতায় থাকা অবস্থায় সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও নানারকম বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধের উপর সঠিক ও সচিত্র দলিল, অনবদ্য সৃষ্টি ‘স্টপ জেনোসাইড’ এবং ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ স্বল্প দৈর্ঘ্যের ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র দুটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনাসহ প্রযোজনাও করেছেন। 

বেগম মুশতারী শফি তার ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইটিতে জহির রায়হান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘সদ্য মুক্ত দেশে এসে যখন শুনলাম, জহির রায়হান নিখোঁজ হয়েছেন তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারে জহির রায়হানসহ আরও অনেকের ঢাকায় ফিরে আসার ব্যবস্থা করেন। জহির রায়হানের সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির (প্রয়াত) ও বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক অরুণ রায় (প্রয়াত)। ঢাকায় নেমেই তারা বিজয়ের অপার আনন্দে ক্যান্টনমেন্ট এবং এর আশপাশে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের নানা দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে যাচ্ছিলেন। ছন্নছাড়ার মতো ক্যামেরা হাতে নিয়ে জহির রায়হান যখন তাঁর টিম সহকারে কাজ করে যাচ্ছিলেন, হঠাত্ কে একজন বলে উঠলেন—‘বাড়ীর খবর কিছু জানেন! আপনার বড়দা ১৪ তারিখ থেকে নিখোঁজ, রাজাকার-আলবদররা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।’ কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই জহির রায়হান পুরনো ঢাকায় কায়েতটুলীর নিজ বাড়িতে ছুটে গেলেন। কর্নেল থুরেজা এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ। কিন্তু সবই বৃথা।

এরপর জহির রায়হান তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় নিজেই আহ্বায়ক হয়ে এনায়েতউল্লাহ খান (প্রয়াত), সৈয়দ হাসান ইমাম, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী (প্রয়াত), ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. সিরাজুল ইসলাম প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে বেসরকারিভাবে গঠন করেন ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’। বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে তিনি দিন-রাত অবিরাম ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 

‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে ২৫ জানুয়ারি প্রেসক্লাবে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে জহির রায়হান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যার অনেক রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমাদের কাছে এমন অনেক তথ্য ও প্রমাণ আছে, যা প্রকাশ করলে অনেকের মুখোশ খুলে যাবে। সময় বুঝে আমি একেক করে সব প্রকাশ করব।’ ৬-১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯-এর সাপ্তাহিক ‘এখনই সময়’ থেকে জানা যায়, ‘অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি জহির রায়হানের সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলনের স্পষ্ট বক্তব্যে তুষ্ট হননি। কেননা, তিনি তাদের কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুই জানতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক দুর্লভ তথ্য তিনি ক্যামেরাবন্দি করে রেখেছিলেন। সংগ্রহ করেছিলেন অনেক ডকুমেন্টস। মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে তারাই কী জহির রায়হানকে সরিয়ে দিয়েছে নাকি অন্য কোনো দেশের চক্রান্ত? মাঝে মধ্যেই শোনা যায়, জহির রায়হান মরেনি। তাকে এখান থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। তিনি ভিন্ন একটি দেশের জেলে আটকা রয়েছেন। 

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে জহির রায়হানকে কেউ একজন পরামর্শ দিয়েছিল, আজমীর শরীফ গেলে সেখান থেকে বলে দেয়া হবে ‘আপনার বড়দা কোথায় আছেন’! পরামর্শানুযায়ী জহির রায়হান তার পরিবারসহ আজমীর শরীফ গিয়েছিলেন। ২৭ জানুয়ারি আজমীর শরীফ থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি জানালেন, ‘আমি জেনে এসেছি আমার বড়দা বেঁচে আছেন।’ ২৮ জানুয়ারি সকালে জনৈক রহস্যজনক ব্যক্তি জহির রায়হানকে কায়েতটুলীর বাড়িতে ফোন করে জানান, ‘শহীদুল্লাহ কায়সার এখনও জীবিত রয়েছেন এবং তাকে মিরপুর ১২নং সেকশনের একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। তাকে যেন অবিলম্বে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়।’ জহির রায়হান তার বড়দা’কে ফিরে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন।

এদিকে মিরপুর পরিস্থিতির নানা আশঙ্কার কারণে জহির রায়হানের পরিবার ৩০ জানুয়ারি বিকালে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটি সাক্ষাত্কার প্রার্থনা করেন এবং নির্ধারিত সময়ে পান্না কায়সার, সুচন্দা ও ড. নিজাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু সব খোঁজখবর নিয়ে তাদের আশ্বাস দেন এই বলে, ‘তোমরা যাও, আমি বিষয়টি দেখছি।’ এরপর রমনা রেসকোর্স থেকে লে. ইব্রাহিমের সঙ্গে মেজর মইনুলের যোগাযোগ রক্ষা হলেও তারা জহির রায়হানের পরিবারকে জহির রায়হানের কোনো খোঁজখবর দিতে পারেননি। পরবর্তীতে মুজিব সরকার জহির রায়হানকে খুঁজে বের করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। 

মিরপুর যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পরদিন থেকেই সেনাবাহিনী সেখানে ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েছিল কিন্তু সে সময় তারা কোন মৃতদেহ খুঁজে পায়নি। অথচ মিরপুরের ওই যুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রায় চল্লিশজন সদস্য নিখোঁজ হন। ১৯ মাঘ ১৪০২ সালের দৈনিক ‘আজকের কাগজে’ সিদ্দিকুর রহমান মিরপুরের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বক্তব্য প্রকাশ করেছেন, ‘কোন পটভূমিতে লে. সেলিমসহ বেশ কয়েকজন সৈনিক এবং পুলিশ অফিসার কচুকাটা হলো? তাদের দেহ কুপিয়ে মাংসের কিমা করা হলো? এবং ঐদিন কেন ঢাকার তত্কালীন সামরিক গভর্নর মিত্রবাহিনীর জেনারেল বিএন সরকারকে নির্লিপ্ত করা হলো? শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না দেখে শেষরাতে মিরপুরে লুকায়িত প্রায় এক সহস্র পাকিস্তানি হিংস্র সৈন্যের অবস্থানে বোমারু বিমান থেকে মিত্রবাহিনী বোমাবর্ষণ করতে বাধ্য হলো?’ সিদ্দিকুর রহমান ঘটনা পরম্পরায় ১৯৭৬ সালে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জাহেদুর রহিমের (প্রয়াত) সঙ্গে আলাপচারিতায় জহির রায়হান সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছিলেন, যা প্রকাশ করার মতো সুসময় তার আজও হয়নি। 

‘সাপ্তাহিক ২০০০’ (১৩ আগস্ট, ১৯৯৯) এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শেষাংশে জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হান প্রতিবেদক হয়ে কিছু বক্তব্য উত্থাপন করেছেন, “জহির রায়হানের পরিবারের সদস্যদের অনেকেরই দৃঢ় ধারণা, ‘মিরপুরের ওই ঘটনার পেছনে রয়েছে পরিকল্পিত চক্রান্ত।’ জহির রায়হান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে নেয়া অনেক মন্ত্রীর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে অনেক দুর্লভ ডকুমেন্টস সংগ্রহ করেছেন বলে তিনি এক প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন। এই হুমকিই তাঁর জীবনের জন্য পাল্টা হুমকি হয়ে ছিল কি না আজ কে বলবে?


সুচন্দা ও ববিতার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ:

বড় বড় নেতার কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়ার কথা বলার পরই জহির নিখোঁজ হন


নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকা ‘ঠিকানা’ পত্রিকায় জহির রায়হানের স্ত্রী অভিনেত্রী কোহিনূর আক্তার সুচন্দা ও তার বোন ফরিদা আক্তার ববিতার একটি সাাৎকারে জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার  চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য তারা ফাঁস করেন। গত ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর এই সাক্ষাৎকারটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিন পুনঃমুদ্রণ করে। এই সাক্ষাৎকারে ববিতা বলেন, জহির ভাই যেদিন বাসা থেকে বের হয়ে যান সেদিন  একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার  তার সঙ্গে ছিলেন এবং ওইদিন রাতেই আমাদের বাসায় ডিনার ছিল।  তিনিই আমাদের ফোন করে জানান, সরি তোমাদের ডিনারে যাওয়া হচ্ছে না। আমি জহিরের সঙ্গে যাচ্ছি।
সুচন্দা বলেন, জহির কোনো পাণ্ডুলিপি রচনার সময় আমাকে পাশে বসাত। এক পাতা লেখা হলে আমাকে দেখাত। আমি বাংলায় মোটামুটি ভালো ছিলাম। আমি যখন দু’এক জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করতাম তখন জহির বলত, তোমার তো খুব ভালো আইডিয়া আছে। বিশেষ করে সংলাপের েেত্র। যুদ্ধের দিন কয়েক আগে একদিন ও বলল, আমি শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ গল্পটির চিত্রনাট্য করে দেব তুমি পরিচালনা করবে। আমার বাচ্চারা খুব ছোট। তখন আমার ছবি পরিচালনায় অভিজ্ঞতা ও আগ্রহ তেমন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কলকাতায় চলে যাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির ছবি তৈরি করার কথা বলে একাই বিশেষ বিমানে বাংলাদেশে চলে আসে। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ভিডিও কিপ ছিল। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রচার করে জহির ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। বাংলাদেশে আসার পর ১৫ দিনের মধ্যে তার কোনো খবর আমরা পাইনি। এদিকে ঘরে খাবার, টাকা-পয়সা নেই। ওই সময় চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর আমাদের বেশ সহযোগিতা করেন।
একদিন শুনলাম  জহিরের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ভাইকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে আমাদের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। জহির প্রতিদিন তার সহকর্মীদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা করত। ওই সময় বাসায় টেলিফোন করে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। জহির আমাদের কিছুই বলত না।  আজও তিনি ফিরে আসেননি। তার মৃতদেহও আমরা পাইনি। কাউকে কি সন্দেহ হয় এ প্রশ্নে সুচন্দা বলেন: বিষয়টি আড়ালে রয়ে গেছে, আমি জহিরকে মনের অন্তরালেই রাখতে চাই। সব কথা সবসময় বলা যায় না। যে বিপদটা তার জীবনে এসেছিল। তিনি প্রেস কাবে দাঁড়িয়ে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যারা এখন বড় বড় কথা বলেন, নিজেদের বড় নেতা মনে করেন তাদের কীর্তি-কাহিনী, কলকাতায় কে কি করেছিলেন, তার ডকুমেন্ট আমার কাছে রয়েছ। তাদের মুখোশ আমি খুলে দেব।’ এ কথা বলার পরই তার ওপর বিপদ নেমে আসে।
একই প্রশ্নের জবাবে  ববিতা  বলেন, জহির ভাইকে বলা হয়েছিল, তোমার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত আছেন। তার চোখ উৎপাটন করে মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরে একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে। তুমি যে তোমার ভাইকে উদ্ধার করতে যাচ্ছ এটা তোমার পরিবারের সদস্যদের বলো না। দিনটির স্মৃতি সম্পর্কে সুচন্দা বলেন, জহির যখন যায় তখনকার দু’তিনটি স্মৃতি আমার মনে এখনো গেঁথে আছে, যেটা কোনোদিনই ভুলার নয়। আমি বুঝতেই পারিনি যে, আমার স্বামীকে হারাতে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল এখনই সিঁড়ি থেকে দৌড়ে এসে আমাকে ডাকলেন সুচন্দা দরজা খুল, আমি এসেছি। এভাবেই কেটে গেল অনেক দিন। জহিরকে কে মারবে? এ দেশের সবাই জহির রায়হানকে চেনে। সুচন্দা বলেন, ঘটনার দিন সকালে আমাদের বাসায় একজন লোক আসে। তড়িঘড়ি জহির তার সঙ্গে বেরিয়ে যায়। ওইদিন বাংলাদেশে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিস, ওয়াহিদা রহমান, লতা মুঙ্গেশকর এফডিসিতে এসেছিলেন। হাসান ইমাম আমাকে ফোন করে বললেন, ম্যাডাম জহির ভাই কোথায়? আমি বললাম জহির বাইরে গেছে।
তিনি বললেন, জহির ভাই না হলে তো হবে না। তবে উনি যেহেতু নেই, আপনাকে তো অবশ্যই আসতে হবে। এত বড় বড় শিল্পী এসেছেন আপনি এবং জহির ভাই না এলে কেমন দেখায়? এফডিসি থেকে আসার পর আমি দেখলাম সবাই বসে রয়েছেন। টেলিফোন সেট সামনে। আমি বাসার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের মেজদা কোথায়? তারা বলল, মেজদা তো মিরপুর গেছেন, আমাদের সঙ্গে নেননি। উনার তো এখনো কোনো খোঁজ নেই। আমি বললাম, খোঁজ নেই মানে? তারা মিরপুর থানায় মেজর মইন এবং মেজর মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। উনারা জানান, উনিতো অপারেশনে আমাদের পুলিশ এবং আর্মির সঙ্গে ভেতরে ঢুকেছেন; কিন্তু ওখানে একটু গণ্ডগোল ও গোলাগুলি হয়েছে, উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বললাম, উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? তারা আরও জানাল, আমাদের অনেক লোক উন্ডেড হয়েছে, এ কথা বলেই টেলিফোন রেখে দিলেন। পরবর্তীতে আমি মেজর মইন এবং মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তাদের কাছে জানতে চাই জহির কোথায় গেল, কীভাবে গেল? উনারা উত্তর দিতে পারেননি। আমি কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। আমি কল্পনাই করতে পারিনি জহির আর ফিরে আসবে না। অনেক খুঁজেও আমরা জহিরকে পাইনি।


মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন কলকাতায় আওয়ামী লীগ নেতারা যা করতেন-ইতিহাসের সাক্ষী
লিখেছেন মাজহার১৩ ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কোলকাতার ৫৮ বালিগঞ্জ বাড়িটি ছিল প্রবাসী সরকারের আবাসিক কার্যালয়। ওই ভবনেই বসবাস ও দাপ্তরিক কাজ করতেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম। প্রয়োজনের তুলনায় ছোট এ বাড়িটিতে সারাক্ষন “জয় বাংলা”র লোকের ভিড় লেগেই থাকত। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা আওয়ামীলীগ দলীয় এমপি, নেতা, আমলা, কর্মী, আত্মীয়স্বজন, আমত্য, চামচা সবার জন্য এ বাড়িটি ছিল অবারিত। ঢালাওভাবে ভাত-গোশত দিয়ে ভুড়ি ভোজ এমনকি নিশি যাপনেও কোনো কার্পণ্য ছিল না। অভ্যাগতদের প্রত্যেকের হাতে দেখা যেত একটা নতুন ব্রিফকেস কিংবা ছোট এট্যাচী, কোন কোন নেতার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। আহার নিদ্রা, এমনকি প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের সময়ও এসব ব্যাগ কাছছাড়া করতো না কেউ। এমন একটি ঘটনায় সেনা কর্মকর্তারা একজন অতিথির ব্রিফকেস পরীক্ষা করে ১২ লাখ পাকিস্তানী রুপী (বর্তমান মূল্য প্রায় ৪৩ কোটি টাকা) উদঘাটিত হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় কর্নেল ওসমানীর জেরার মুখে ভদ্রলোকটি টাকার কথা চেপে যান। পরে উদ্ধারকৃত বিপুল টাকা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে জমা করে দেয়া হয়। মূলত: দেশ ছাড়ার আগে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা পূর্ব বাংলার ব্যাংক ট্রেজারীগুলো সব উজাড় করে অর্থ ও সোনাদানা নিয়েই পাড়ি জমান ভারতবর্ষে। আহমদ ছফা এ জাতীয় আরেকটি ঘটনার কথা বর্ণনা করেন এভাবে, “এই সোনা তো বাংলাদেশের জনগনের সম্পত্তি।…যে তিনজন আমরা সোনা নিয়ে এসেছিলাম তারমধ্যে একজন এমপি’র আপন ছোট ভাই। আরেকজন স্থানীয় আওয়ামীলীগ প্রেসিডেন্টের শালা। তারা এখন কোথায় আছে কি করছে, কিছু জানিনে। অথচ এদিকে শুনতে পাচ্ছি সেই সোনা ইতোমধ্যে ভাগভাটোয়ারা হয়ে গেছে।.....সত্যিই তো এরকম একজন মানুষ দেড় মন সোনা বয়ে নিয়ে এসেছে শুনলে এখনকে বিশ্বাস করবে? (অলাতচক্র, পৃষ্ঠা ৬২)।
বিভিন্ন শরনার্থী শিবির পরিচালনার দায়িত্বে ভারত সরকারের লোকের পাশাপাশি আওয়ামী নেতারাও ছিলেন। এসব নেতাদের বেশীরভাগই পরিবার পরিজন সমেত বেশ আয়েশী জীবন যাপন করতেন। এমনকি অভিজাত দোকান, সুরিখানা ও নাইটক্লাবগুলো জয়বাংলার লোকে ছিল জমজমাট। তখন পশ্চিম বাংলায় “জয় বাংলা”র লোক মানেই বাড়তি খাতির। এ নিয়ে ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল লিখেছেন,“আমি যখন তাদেরকে দেখেছি কোলকাতার অভিজাত এলাকার হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে জমজমাট আড্ডায় ব্যস্ত। একাত্তরের সেই গভীর বর্ষায়ত দিনরাতে কোলকাতার অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে বসে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে হাটুতক কাদা জলে ডোবান্ত মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবিরগুলোতে অবস্থানরত হাজার হাজার তরুনের বেদনাহত চেহারাগুলো তারা একবারও দেখেছে কিনা তা আজও আমার জানতে ইচ্ছা করে। আমার জানতে ইচ্ছে করে কোলকাতার পার্ক স্ট্রীটের অভিজাত নাইট ক্লাবগুলোতে ‘বীয়ার’ হুইসকি পানরত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মনোমুকুরে একবারও ভেসে উঠেছে কিনা সেই গুলিবিদ্ধ কিশোর কাজলের কথা যে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত চীৎকার করে ঘোষণা করেছে ‘জয় বাংলা’। আমার জানতে ইচ্ছে করে আরো আরো অনেক কিছু। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করলেই তো আর জানা যায় না।” কলকাতা ও আগরতলার নাইট ক্লাব ও বেশ্যালয়ে প্রবাসী নেতাদের অনেকেরই নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। প্রবাসী সরকারের একজন মন্ত্রী সোনাগাছির বেশ্যালয়ে মারামারি করে কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অবশেষে মুজিবনগর সরকারের কাছে হস্তান্তরিত হয়। আহমদ ছফা ঘটনাটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, “যে সকল মানুষকে দেশে থাকতে শ্রদ্ধা করতাম, কলকাতায় অনেকের আচরণ দেখে সরল বাংলায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়- তাই হতে হচ্ছে। এখনও তোমরা স্যার ডাকছ তার বদলে শালা বললেও অবাক কিছু ছিল না। এখানকার একটা সাপ্তাহিক খবরটা ছেপেছে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী নাকি সোনাগাছিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। জানেন তো স্যার, সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত?…পুলিশ অফিসারের জেরার মুখে ভদ্রলোককে কবুল করতেই হল, তিনি ভারতে প্রবাসী সরকারের একজন মন্ত্রী। পুলিশ অফিসার তখন বললেন, তাহলে স্যারের গুডনেমটা বলতে হয়। মন্ত্রী বাহাদুর নিজের নাম প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ভেরিফাই করে দেখে যে বক্তব্য সঠিক। পুলিশ অফিসারটি দাঁতে জিভ কেটে বললেন, স্যার কেন মিছিমিছি সোনাগাছির মত খারাপ জায়গায় নিজেকে নাহক ঝুট-ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। আর ভারত সরকারের আতিথেয়তার নিন্দে করবেন। আগে ভাগে আমাদের স্মরণ করলেই পারতেন, আমরা আপনাকে ভিআইপি-র উপযুক্ত যায়গায় পাঠিয়ে দিতাম (ছফা, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ২০-২১)। এসব নেতাদের কীর্তিকলাপ নিয়ে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র ঘৃনা উঠে এসেছে আহমদ ছফার কলমে, “কলকাতা এলে মাথায় খুন চেপে বসে। ইচ্ছা জাগে এই ফর্সা কাপড় পরা তথাকথিত নেতাদের সবকটাকে গুলি করে হত্যা করি। এ্যায়াসা দিন নেহি রয়েগা। একদিন আমরা দেশে ফিরে যাব। তখন সব কয়টা বানচোতকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে মারব। দেখি কোন বাপ সেদিন তাদের উদ্ধার করে। কলকাতার নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পোলাও-কোর্মা খাওয়ার মজা ভাল করে ‍দেখিয়ে দেব” (ছফা, ৮১)।
“স্টপ জেনোসাইড” খ্যাত চলচ্চিত্রকার কাজী জহির রায়হান যুদ্ধকালে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আওয়ামীলীগ নেতাদের অপকর্মের অনেক ফুটেজ ও ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেন, যা দিয়ে তিনি ডকুমেন্টারী বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট পাপিষ্ঠরা এসব কারনে জহির রায়হানকে গায়েব করে দেয়, তার লাশটিও খুঁজে পাওয়া যায় নি। জহির রায়হান সংবাদ সম্মেলন করে এসব চিত্র প্রকাশের হুমকি দিয়েছিলেন। আর এ হুমকির পরই তাঁর অন্তর্ধানের ঘটনা ঘটে। জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার যুদ্ধকালে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর দ্বারা অপহৃত হন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারী ভাইকে খোঁজার নাম করে জহির রায়হানকে ডেকে নেয় স্বাধীন বাংলার প্রশাসন পরিচিতরা। এরপর থেকে জহির নিখোঁজ। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুজিব সকারের পুলিশ ও মিরপুর এলাকা নিয়ন্ত্রকারী বাহিনী জহির রায়হানের পরিবারকে সাহায্য করার পরিবর্তে এড়িয়ে যেতেন। জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ. জলিল লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের আওয়ামীলীগ নেতাদের কুকীর্তি ফাঁস করে দিতে চাওয়ায় নিখোঁজ হন সাংবাদিক জহির রায়হান। ভারত অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক এবং চিত্র নির্মাতা কাজী জহির রায়হান। তিনি জেনেছিলেন অনেক কিছু, চিত্রায়িতও করেছিলেন অনেক দুর্লভ দৃশ্যের। কিন্তু অতসব জানতে বুঝতে গিয়ে তিনি বেজায় অপরাধ করে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই তাকে সেই অনেক কিছু জানার অপরাধেই প্রাণ দিতে হয়েছে। ভারতের মাটিতে অবস্থান কালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চুরি, দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা, যৌন কেলেংকারী, বিভিন্ন রূপ ভোগ-বিলাস সহ তাদের বিভিন্নমূখী অপকর্মের প্রমাণ্য দলীল ছিল- ছিল সচিত্র দৃশ্য। আওয়ামী লীগের অতি সাধের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজী জহির রায়হানের এতবড় অপরাধকে স্বার্থান্বেষী মহল কোন যুক্তিতে ক্ষমা করতে পারে? তাই বেঁচে থেকে স্বাধীনতার পরবর্তী রূপ দেখে যাওয়ার সুযোগ আর হয়নি জহির রায়হানের। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩ নম্বর আসামী স্টুয়ার্ড মুজীবেরও ঘটেছিল এই পরিণতি। এই দায়িত্বশীল নিষ্ঠাবান তেজোদীপ্ত যুবক স্টুয়ার্ড মুজীব ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে এবং পরে ৮ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। তার মত নির্ভেজাল ত্বরিতকর্মা একজন দেশপ্রেমিক যুদ্ধা সত্যিই বিরল। প্রচন্ড সহস ও বীরত্বের অধিকারী স্টুয়ার্ড মুজীব ছিল শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয় অন্ধভক্ত। মাদারীপুর থানার অন্তর্গত পালং অধিবাসী মুজীবকে দেখেছি বিদ্যুতের মতই এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছুটোছুটি করতে। কি করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করা যায়, ভারতের কোন নেতার সাথে যোগাযোগ করলে মুক্তিযুদ্ধের রসদ লাভ করা যায় কেবল সেই চিন্তা এবং কর্মেই অস্থির দেখেছি স্টুয়ার্ড মুজীবকে। মুজীব ভারতে অবস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেক কুকীর্তি সম্পর্কেই ছিল ওয়াকিফহাল। এতবড় স্পর্ধা কি করে সইবে স্বার্থান্বেষী মহল। তাই স্বাধীনতার মাত্র সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই ঢাকা নগরীর গুলিস্তান চত্তর থেকে হাইজ্যাক হয়ে যায় স্টুয়ার্ড মুজীব। এভাবে হারিয়ে যায় বাংলার আর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। (পৃষ্ঠা ৫৫, ৫৬)
জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তার সহধর্মীনি চিত্রনায়িকা সুচন্দা বলেন,”জহির বেঁচে থাকা অবস্থায় সর্বশেষ প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে এক বক্তব্যে বলেছিলেন­, যারা এখন বড় বড় কথা বলেন, নিজেদের বড় বড় নেতা মনে করেন, তাদের কীর্তি কাহিনী, কলকাতায় কে কী করেছিলেন, তার ডকুমেন্ট আমার কাছে রয়েছে। তাদের মুখোশ আমি খুলে দেবো।’ এই কথা তিনি মুখ দিয়ে প্রকাশ্যে বলে ফেলার পরই তার উপর বিপদ নেমে আসে। এই বলাটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।” জহির রায়হানের বোন নাসিমা কবির যখন নিখোঁজ জহির রায়্হারের খুঁজে বড় বড় নেতাদের কাছে রাত দিন পাগলের মত ছুটে গেছেন। ১৯৭২ সালে পত্রিকা গুলোতে বেশ লেখালেখি শুরু হয়। যে রফিকের ফোন পেয়ে জহির রায়হান ঘর থেকে বের হয়ে যেন, সেই রফিককে একদিন হঠাৎ করে সপরিবারে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। জহির রায়হানের বড় বোন নাসিমা কবিরকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি বললেন - ”জহিরকে নিয়ে বেশি চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে” (দৈনিক আজকের কাগজ,৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩)। অর্থাৎ শেখ মুজিব নিজেও জহির রায়হানের গুমকারীদের সঙ্গে আপোষ করেছিলেন!
কেবল জহির রায়হানই নয়, যুদ্ধকালে প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন নেতাদের দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে শেখ মুজিবের কাছে ট্রাইবুনাল গঠন করার বিচার ও তাদেরকে দল থেকে বহিস্কারের দাবীও তোলে স্বাধীন বাংলা যুব কমান্ড। মুজিব নগর সরকারের ১০০ কোটি রূপী (বর্তমান মূল্য প্রায় ৩৫,৭০০ কোটি টাকা) খরচের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি (ইত্তেফাক ১৫ আগষ্ট ১৯৭২)। প্রবাসী সরকারের কর্তাব্যক্তি এবং নেতাদের দুর্নীতি ও নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের নানা প্রমানাদি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে - জনতার আদালতে বিচারের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
লেখক: মোঃ শামসুল আলম

ডেপুটি সেক্রেটারী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার


যারা এখন বড় বড় কথা বলেন তারাই জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার সঙ্গে জড়িত...
- সুচন্দা ও ববিতা



বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যাদের হাত ধরে সম্মানের সাথে বুক চিতিয়ে সামনে চলা শুরু করে, তাদের মধ্যে প্রথম যে দু’জনের নাম আসে, তাদের একজন সুচন্দা, অন্যজন ববিতা। দুই বোন। সুচন্দার পুরো নাম কহিনুর আক্তার এবং ববিতার ফরিদা আক্তার। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তারা পুষ্ট ও উজ্জীবিত করে তুলেছেন তাদের সকল ভালবাসা, মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে যেমন আন্তর্জাতিক বিশ্বে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি তারাও হয়েছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে নন্দিত, তাদের ভালবাসায় হয়েছেন অভিষিক্ত। অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। আন্তর্জাতিকভাবে হয়েছেন পুরস্কৃত। সেই সুচন্দা- ববিতা সম্প্রতি এক ব্যতিক্রমধর্মী সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।কানাডার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস এ প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের সার সংক্ষেপ ব্লগারদের জন্যে এখানে উপস্থাপন করা হলো-


চলচ্চিত্রের একাল- সেকাল, পারস্পরিক সহমর্মিতা, ভালবাসা, পারিবারিক বন্ধন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তারা। বলেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান পুরুষ সুচন্দার স্বামী জহির রায়হানের রহস্যময় অন্তর্ধান নিয়ে অনেক অজানা কথা। সুচন্দা গভীর আবেগ নিয়ে বলেন, জহির যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমাকে পাশে বসাতেন স্ক্রিপ্ট লিখার সময়। একটি পাতা লিখা হলে সঙ্গে সঙ্গে তা আমাকে দেখাতেন। আমি আবার মোটামুটি বাংলায় ভাল ছিলাম। আমার মাও বাংলায় লেখালেখি করতেন। সেখান থেকেই আমার বাংলা লেখালেখির প্রতি প্রচন্ড আগ্রহের সৃষ্টি হয়। আমি যখন দুই একটি জায়গায় একটু পরিবর্তন করে দিতাম তখন জহির বলতো, তোমারতো খুব ভাল আইডিয়া আছে, ভাল বুঝতে পার। বিশেষ করে ডায়ালগ ও স্ক্রিপ্ট। এক সময় তিনি বললেন ( যুদ্ধের ঠিক আগে), ঠিক আছে আমি একটা কাজ করবো, আমি দেবদাস গল্পটার চিত্রনাট্য করে দেবো তুমি পরিচালনা করবে। তখন আমার বাচ্চারা ছোট, আমি বললাম, এত আগে আমি পরিচালনায় আসবো না, আমার আরো অভিজ্ঞতা হোক। তার পর পরই যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ শুরু হবার পর জহিরের সাথে আমরা কলকাতা চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম। দেশ স্বাধীন হবার পর জহির আমাদের রেখেই স্পেশাল ফ্লাইটে বাংলাদেশে চলে আসলো ছবি তৈরি করার কথা বলে। ছবিটি করার কথা দেশ স্বাধীনের উপরে। তার কাছে অসংখ্য ক্লিপ ছিলো। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রচার করে সে সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। সে যাই হোকে তিনি আসার সময় বলেছিলেন আমাদের দুই দিন পর এসে নিয়ে যাবেন। দুই দিনের কথা বলে এসে প্রায় ১৫ দিন তার কোন খবর নেই। আমাদের ঘরে খাবার নেই, অর্থ নেই, খুবই করুণ অবস্থা। আমাদের পাশেই থাকতেন আলমগীর কবীর। তিনি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসলেন- সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছিলেন, আমাদের দেখাশুনা করেছিলেন। আমরা পরবর্তীতে শুনলাম যে জহিরের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। ভাইকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত। বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছেন, খোঁজ- খবর নেয়ার চেষ্টা করছেন। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে বউ এবং বাচ্চাদের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। উনিতো কাজ পাগল মানুষ ছিলেন, অনেকটা আতভোলার মত। কাজের সামনে স্ত্রী- সìতান তার কাছে বড় ছিলো না। অবশেষে ১৬/১৭ দিন পর আলমগীর কবীর সাহেব আমাদের জন্য প্লেনের টিকেট কেটে দিলেন। আমরা বাংলাদেশে আসলাম। আসার কয়েক দিন পর বাংলাদেশে থেকে আমরা আবার কলকাতায় গেলাম। কলকাতা থেকে আসার পর বাসায় মিথ্যা টেলিফোন করে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে জহিরকে নিয়ে যাওয়া হলো। জহির কিন্তু আমাদের কিছুই বলতো না। আমি উপরে থাকতাম, জহির নিচে লোকজনদের নিয়ে প্নান করছে, কি করা যায়। জহির কে নিয়ে যাবার পর সে আর ফিরে আসেনি। এমন কি তার মৃত দেহও আমরা পাইনি।


কাউকে কি সন্দেহ হয় বা অন্য কিছু মনে হয়?


সুচন্দা : কিছু না কিছু মনে তো হয়ই। আজ পর্যন্ত আমি এ বিষয়টি বলিনি এবং এখনো বলতে চাই না। যে বিষয়টি আড়ালে রয়ে গেছে, আমি তাকে মনের অন্তরালেই রাখতে চাই। কারণ সব কথা সব সময় বলা যায় না, বললে অনেক সময় বিপদ এসে যায়। যে বিপদটা জহিরের জীবনে এসেছিলো। জহির বেঁচে থাকা অবস্থায় সর্বশেষ প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে এক বক্তব্যে বলেছিলেন­ ’যারা এখন বড় বড় কথা বলেন, নিজেদের বড় বড় নেতা মনে করেন, তাদের কীর্তি কাহিনী, কলকাতায় কে কী করেছিলেন, তার ডকুমেন্ট আমার কাছে রয়েছে। তাদের মুখোশ আমি খুলে দেবো।’ এই কথা তিনি মুখ দিয়ে প্রকাশ্যে বলে ফেলার পরই তার উপর বিপদ নেমে আসে। এই বলাটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।


ববিতা : (সুচন্দার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) জহির ভাইকে বলা হলো যে, তোমার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার জীবীত আছে, মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরে চিলেকোঠার একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে, তার দুটো চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, তবে সে জীবিত আছে। তুমি যে তোমার ভাইকে উদ্ধার করতে যাচ্ছো এটা তোমার মা, স্ত্রী এবং আতীয়- স্বজনদের বলবে না।


সুচন্দা : জহির যখন যায় তখনকার দুই তিনটি স্মৃতি আমার মনে এখনো গেঁথে আছে- যেটা কোন দিনই ভুলবার নয়। ভুলতে পারবো না। আমি বুঝতেই পারলাম না যে আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে এখনই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে এসে আমাকে ডাকবে­ সুচন্দা, দরজাটা খোল, আমি এসেছি। এভাবেই কটে গেল অনেক দিন। আমার মনেই হয় না জহিরকে কেউ মেরে ফেলবে, জহিরকে কে মারবে? জহির মরতেই পারে না। জহির রায়হানের মত লোককেতো কেউ মারতে পারে না। কারণ বাংলাদেশের সবাই জহির রায়হানকে চিনে।


ববিতা : জহির ভাই যে দিন বাসা থেকে বের হয়ে যান সেই দিন একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার জহির ভাই-এর সাথে ছিলেন এবং সেই দিন রাতে আমাদের বাসায় ডিনার ছিলো। তিনিই আমাদের ফোন করে জানালেন- স্যরি তোমাদের ডিনারে যাওয়া হচ্ছে না। আমি জহিরের সাথে যাচ্ছি।


সুচন্দা : এ রকম না। ঘটনার দিন সকাল বেলায় আমাদের বাসায় একজন লোক আসলো। খবরটি জহিরকে দিতেই সে তড়িঘড়ি করে নামাজ পড়ে নিচে নেমে গেল। সেই সময় আমি নাস্তা তৈরি করে নিয়ে আসলাম, জহিরকে নাস্তা করতে বললাম, সে বললো আমার সময় নেই। জুতা পরছিলো। আগেই বলেছি জহির একটু আত্নভোলা ছিলো। জামা- কাপড়ের প্রতি তার কোন খেয়াল ছিলো না, সব সময় তাকে আমার জামা- কাপড় দিতে হতো। বলতে হতো এটা পড়, ওটা পড়। জুতা পরার সময় আমি বললাম তোমার মুজাটাতো ময়লা হয়ে গিয়েছে, এটা খুলে রেখে যাও। সে আমার কথা শুনলো না, বললো, না না আমি এখন যাই। আমি আসার পরে তুমি এটা ধুয়ে দিও। জহির দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে চলে গেল, আমি তার পায়ের আওয়াজ পেলাম। দুই মিনিট পর সে আবার ফিরে আসলো এবং আমাকে বললো সুচন্দা আমাকে কিছু টাকা দাওতো। কারণ তার কাছে কখনো টাকা পয়সা থাকতো না। টাকা পয়সা সে সব সময় তার ভাই অথবা তার ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে রাখতো। আমাকে বললো- আমার কাছেতো টাকা নেই। আমি তখন আলমারী খুলে তাকে টাকা দিলাম। ঐ দিন বাংলাদেশে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিস, ওয়াহিদা রহমান, লতা মুঙ্গেশ করসহ অনেক বড় বড় শিল্পী এফডিসিতে এসেছিলেন। হাসান ইমাম সাহেব ফোন করলেন। আমাকে ফোন করে বললেন, ম্যাডাম, জহির ভাই কোথায়? আমি বললাম, জহির নেই, সে বাইরে গিয়েছে। তখন তিনি আমাকে বললেন, জহির ভাই না হলে তো হবে না। তবে উনি যেহেতু নেই, আপনাকেতো অবশ্যই আসতে হবে। এত বড় বড় শিল্পী এসেছেন আপনি এবং জহির ভাই না আসলে কেমন দেখায়? শহীদুল্লাহ কায়সারকে আমি বড়দা বলতাম। এ পরিস্থিতিতে আমারও খারাপ লাগছে বড়দা নেই। জোরা জুরি করার পর অগত্যাই আমি গেলাম। সেখান থেকে আসার পরে আমি দেখলাম সবাই বসে রয়েছে। টেলিফোন সামনে। আমি বাসার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম- তোমাদের মেঝ দা কোথায়? তারা বললো, মেঝ দা তো মিরপুরে গিয়েছিলো, আমাদেরতো সঙ্গে নেয়নি। মেঝ দারতো এখন কোন খোঁজ নেই। আমি বললাম- মেঝ দার খোঁজ নেই মানে? তারা আমাকে ফোনে ধরিয়ে দিলো মিরপুর থানা। টেলিফোনের ঐ প্রান্ত থেকে জানালো- ধরুন একজনকে দিচ্ছি। ফোনে মেজর মইন এবং মেজর মতিউর রহমান দু’জন জানালেন- আপনি একটু পরে ফোন করেন। কারণ আমাদের দরকারি টেলিফোন এসেছে। আমি বললাম, ঠিক আছে। তার কিছুক্ষণ পর আমি আবার ফোন করলাম। তারা তখন জানালো- উনিতো অপারেশনে আমাদের পুলিশ এবং আর্মির সাথে ভিতরে ঢুকেছেন কিন্তু ঐখানে একটু গন্ডগোল হয়েছে, গুলিগালা হয়েছে, উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বললাম- কী বলেন? উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? তারা আরো জানালো আমাদের অনেক লোক উন্ডেড হয়েছে­ এ কথা বলেই টেলিফোন রেখে দিলেন। আমি পরবর্তীতে মেজর মইন এবং মতিউর রহমানের সাথে দেখা করতে যাই। তাদের কাছে জানতে চাই- জহির কোথায় গেল, কীভাবে গেল? উনারা এ সব প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর আমাকে দিতে পারেন নি। আমি খুব মনক্ষুন্ন হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। তখন আমার অবস্থা পাগলের মত। এক দিকে শহীদুল্লাহ কায়সার চলে গেলেন, আমার অনেক আত্নীয়- স্বজন মারা গেলেন। যুদ্ধের সময় কলকাতায় অমানুষিক কষ্ট করেছি। খাওয়ার অর্থ ছিলো না। ডাল চরচরি, আটার রুটি, কোন রকম নিজের হাতে বানিয়ে খেয়েছি। এমন ঘরের মধ্যে ছিলাম যেখানে নিশ্বাস নেয়াও কষ্ট ছিলো, ভাড়া করেতো ভাল ঘরে থাকার মত অবস্থা ছিলো না। অনেক কষ্ট করে দেশ স্বাধীন হলো। কত ভাল লেগেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কষ্টটা স্বার্থক হবে সেই আনন্দটুকু আমি আর পেলাম না। কাঁদতে কাঁদতে চলে আসলাম। কেউ মারা গেলে যেমন মানুষ চিৎকার করে কাঁদে, হাউ মাউ করে কাঁদে, কিছুটা হলেও হাল্কা হয়, আমি সেটা করতে পারিনি, আমি বুঝতে বা কল্পনাই করতে পারিনি- জহির যে আর ফিরে আসবে না। সে এভাবে নিখোঁজ হবে এবং তার মরদেহ পাবো না। তার পনের দিন পরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে মিরপুরে গেলাম। মিরপুরে যাবার পর সেই সময় যাদের জবাই করে, গুলি করে, নির্যাতন করে হত্যা করা হয়, তাদের যেখানে কবর দেয়া হয় সেই সব জায়গায় অনেকের সহযোগিতায় মাটি খুঁড়ে দেখলাম। নাকে কাপড় দিয়ে দুর্গন্ধের মধ্যে লাশ খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাশগুলো পচেগলে এমন অবস্থা হলো যে তা চিনার কোন উপায়ই ছিলো না। কোন লাশের গায়েই কাপড় ছিলো না। সে এক বিভৎস্ দৃশ্য। এগুলো যুদ্ধের পরের ঘটনা। জহির মারা যাবার সময়ের।




মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে হত্যা করেছিল কারা?

লিখেছেন আমি আহমেদ মুসা বলছি 

আজ ৩০শে জানুয়ারী জহির রায়হান অন্তর্ধান দিবস। কিন্তু আজো স্বাধীন বাংলার মানুষ জানতে পাড়েনি ঠিক কি কারণে ? কারা তাকে গুম বা হত্যা করে ? 


বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মোর্শেদুল ইসলাম,তানভীর মোকাম্মেল,তারেক মাসুদ-এর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পরিচালকের আবির্ভাব হলেও সব মিলিয়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে জহির রায়হানের মত প্রতিভা সম্পন্ন দ্বিতীয় চলচ্চিত্রকার বাংলাদেশে এখনো আসেন নি।যে পাকিস্তানীরা ভাবতো বাংলাদেশ এর আবহাওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণই সম্ভব না,সেখানে তিনি একের পর এক ভালো ছবি নির্মাণ করেছেন এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছিলেন। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়,রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি ছিলেন খুবই সক্রিয়।বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের বামপন্থী রাজনীতির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল ছাত্র জীবনেই, তাদের গোপন সংবাদ আদান-প্রদান করার মাধ্যমে।তাঁর প্রতীতি জন্মেছিল,মানুষের মুক্তি পথেই,যদিও বড় হয়েছিলেন, রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে।বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্রকার নামে যদি কাউকে অভিহিত করা হয় তাহলে তিনি হবেন জহির রায়হান,যিনি যুদ্ধ করেছেন ক্যামেরা দিয়ে।ক্যামেরা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন রণাংগনে,জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুলে এনেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল,যা প্রচার পেয়েছিল বিশ্বব্যাপী। তিনি চিন্তায় এতোটাই অগ্রসর ছিলেন যে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ জন্মের প্রক্রিয়া যে শুরু হয়ে গেছে তা বুঝে গিয়েছিলেন এবং তার খবর দেশের মানুষের কাছে আগাম পৌঁছে দেয়ার জন্য তৈরি করেছিলেন অসামান্য ছবি জীবন থেকে নেয়া,-গেয়েছিলেন শিকল ভাঙ্গার গান। যুদ্ধের সময় রণাংগনে এবং ভারতে মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ এর অস্থায়ী সরকারের কর্মকান্ডকে ডকুমেন্টারি ছবির মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ধরে রাখার জন্যেও তুলেছিলেন অনেক ছবি।বেঁচে থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রক্ষাপটে তিনি হয়তো আমাদের উপহার দিতে পারতেন আরো অসাধারণ সব ছবি,বিশ্বের চলচ্চিত্র অংগনে বাংলাদেশের ভাব-মূর্তি আরো উজ্জ্বল হতে পারতো।জহির রায়হান এর মৃত্যুতে সবচে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র,এদেশের মানুষ এবং তাঁর সন্তানেরা।স্বাধীনতার পরে চোরা কারবারের টাকা দিয়ে অশিক্ষিত চিত্র পরিচালকদের হাতে কুরুচি পূর্ণ ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির যে ধারা শুরু হয়েছিল বেঁচে থাকলে জহির রায়হান একাই হয়তো তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ভালো ছবির দিকে তা ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জহির রায়হানের অকাল মৃত্যু নিয়ে রয়েছে নানা রহস্য।কেউ বলে তাকে হত্যা করেছে ঘাপটি মেরে থাকা রাজাকার,আল বদররা।কেউ বলে বিহারীরা।আর জামাত-শিবির সমর্থকরা নানান যুক্তি তুলে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একাংশ এবং ভারতীয় বাহিনীর দিকে।শেষোক্ত মতামতটি গতি পেয়েছে জহির রায়হানের মৃত্যু রহস্য তদন্তে আওয়ামী লীগ সরকারের অনীহার কারণে।এক্ষত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শহীদ বুদ্ধি জীবী পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনদের হত্যার বিচারের দাবীতে ৩২ নম্বরে স্মারক লিপি দিতে গেলে পুলিসের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেনমহিলারা সহ।এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রাপ্য মূল্যায়ন করা হয়েছিল বলে মনে হয় না।প্রতি বছর বুদ্ধিজীবীদের নাম এবং ছবি ছাপা হয়েছে,বিবৃতি দেয়া হয়েছে,কিন্তু জহির রায়হানের নাম যেন অনেকটা অবহেলা ভরেই শুধু তার অন্তর্ধান দিবসে উল্লেখ করা হত।তাকে নিয়ে সভা-সেমিনার হতেও খুব একটা শোনা যায় নি।আর এসবই এই তৃতীয় মতকে জোরদার করেছে। আমি জানি না বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষণজন্মা পুরুষটকে কোন গোষ্ঠিটি হত্যা করেছিল।আর প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো মতামত নেই।

আধারে ঘেড়া সেই রহস্য :
১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি।আলিয়স ফ্রসেজ- হচ্ছিল বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি ফেডারেশনের একটি সেমিনার,জহির রায়হানের জীবনী এবং চলচ্চিত্রের উপর।সেখানে আমার ছোটবেলার প্রিয় শিশু-সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রযোজক ইসলাম ভাইকে আসল নাম দিলাম না,তিনি এখন বড় কর্মকর্তা নিয়ে গেলাম সেখানে।তিনি- প্রধান অতিথি ছিলেন।এই ভদ্রলোক ছিলেন জহির রায়হানের কাজিন শাহরিয়ার কবিরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধু।জহির রায়হানের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা শেষে অনিবার্য ভাবেই এলো তাঁর অন্তর্ধান প্রসংগ।এ পর্যায়ে এসে তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন।তিনি বললেন,স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জহির রায়হানকে কারা হত্যা করেছে আমি তা জানি।কিন্তু বলবো না।তখন উপস্থিত প্রায় শখানেক তরুণ চলচ্চিত্র প্রেমিক চিতকার করে হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করতে বললো তিনি তখন বললেন,আমি যদি এখন নাম প্রকাশ করি তাহলে কাল আমার লাশ রাস্তায় পড়ে থাকবে।সেটা ছিল ১৯৮৭ সাল। 

[নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সত্যানুসন্ধানীর ব্যাক্তিগত বয়ান থেকে]


সাপ্তাহিক বিচিত্রা - ০১ মে, ১৯৯২ সংখ্যায় সত্যজিত রায়-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত সেখানে জহির রায়হান অন্তর্ধান নিয়ে যা বলা হয় তা তুলে ধরা হল :

সত্যজিত রায় : জহিরের ব্যাপারটা কিছু জেনেছো?

শাহরিয়ার কবির : তাকে সরিয়ে ফেলার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে যা বুঝতে পেরেছি তাতে বলা যায় ৩০ জানুয়ারি দূর্ঘটনায় তিনি হয়তো মারা যাননি। তারপরও দীর্ঘদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।

সত্যজিত রায় : স্ট্রেঞ্জ ! জহিরকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কারণ কি?

শাহরিয়ার কবির : সেটাই ষড়যন্ত্রের মূলসূত্র বলে ধরছি। মিরপুর দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হলে গভীর ষড়যন্ত্র মনে করার কারণ ছিল না। আমি যতদূর জানি, বুদ্ধিজীবিদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সেজন্য তাকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল॥ 

আমি আওয়ামী লীগ, বিএনপি,জামাত,বামপন্থী বা এরশাদ পন্থী নই।অনেকের মত বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। তাই জহির রায়হান অন্তর্ধান জানতে চাই আজো, আছেন কেও জানাবেন ???



Post a Comment

0 Comments